রুপালি ডেস্ক: বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রিতে এমন কিছু ঘটনা আছে, যা আজও আলোচিত। ১৯৯৪ সে রকমই একটি বছর। কারণ, সে বছর ইলিয়াস কাঞ্চনের ‘সিপাহী’ এবং আলমগীরের ‘দেশপ্রেমিক’ সিনেমা দুটোই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের বেলায় শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছিলেন আলমগীর। তখন প্রশ্ন উঠেছিল, ইলিয়াস কাঞ্চন কি তাহলে বঞ্চিত হলেন?
প্রখ্যাত পরিচালক কাজী হায়াতের রাজনৈতিক, দেশপ্রেমমূলক গল্পে ইলিয়াস কাঞ্চনের শক্তিশালী অভিনয় ছিল একজন কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসারের চরিত্রে। চরিত্রটি যেমন আবেগপ্রবণ, তেমনি দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ। দর্শকরা বলেছিলেন, এটা ইলিয়াস কাঞ্চনের “ সেরা পারফরম্যান্স।”
অন্যদিকে, দেশপ্রেমিক সিনেমায় আলমগীর ছিলেন একজন আদর্শবান চলচ্চিত্র নির্মাতা। যিনি দেশের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলেন নির্মানশৈলিতে। চরিত্রটি ছিল আরও বেশি নাটকীয়, কিছুটা কল্পনাভিত্তিক ও আদর্শে ভরপুর।
১৯৯৪ সালের জাতীয় পত্রিকায় “সিপাহী” নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা উঠে আসে। পত্রিকায় সেই সময় ইলিয়াস কাঞ্চনের সিপাহী নিয়ে কি লেখা হয়েছিল? দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদসহ একাধিক পত্রিকায় “ইলিয়াস কাঞ্চনের অভিনয় ছিল দুর্দান্ত, বাস্তব, এবং জাতির মনের কথা বলা এক চরিত্র”-এমন ভাষ্য প্রকাশিত হয়। অনেক সমালোচক লিখেছিলেন, “ইলিয়াস কাঞ্চন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের যোগ্য, যদি শুধু অভিনয়ের বিচার হয়।”
অপরদিকে, “দেশপ্রেমিক”-সিনেমার প্রশংসাও কম ছিল না। তবে অনেকটাই ছিল আলমগীরের আগের সুনামের ভিত্তিতে। তাছাড়া আলমগীর তখন ইলিয়াস কাঞ্চনের তুলনায় ছিলেন অনেক সিনিয়র। সেই বছরের জুরি বোর্ড নিয়ে পরোক্ষভাবে অভিযোগ শোনা গিয়েছে যে, “নিরপেক্ষতা কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিল।” জানা যায়, তখন আলমগীরের চলচ্চিত্রজগতের রাজনৈতিক যোগাযোগ অনেক গভীর ছিল। এমনও গুঞ্জন ছিল যে, তিনি সরকারি পর্যায়ে প্রভাবশালী মহলে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতেন, যা হয়তো কোনো না কোনোভাবে প্রভাব ফেলতে পারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নির্ধারণের ক্ষেত্রে। তবে এটা কোন সময়ই প্রমাণিত হয়নি।
১৯৯৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সেরা অভিনেতার পুরস্কার না পেয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন কি প্রশ্ন তুলেছিলেন? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো ‘না’! কেন তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া হলো না এ নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন কখনোই সরাসরি অভিযোগ করেননি, বরং তিনি বলেছিলেন, “আমার কাজের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে দর্শকরা আমাকে মনে রাখবে, পুরস্কার না পেলেও আমি দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছি।”
‘সিপাহী’ ছবি মুক্তির বেশ আগেই সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যান ইলিয়াস কাঞ্চনের স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন। তারপর থেকে অভিনয়ের পাশাপাশি সমাজসেবামূলক কাজেও যুক্ত হন ইলিয়াস কাঞ্চন। সে সময় থেকেই “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনের ভিত রচনা শুরু হয়।
ক্যারিয়ারে নয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন আলমগীর। সেই বছর পুরস্কার গ্রহণের পর আলমগীর বলেন,“এই পুরস্কার আমি আমার মেধা ও পরিশ্রম দিয়েই পেয়েছি।” অনেকের মত, আলমগীরের পুরস্কার “একটু বেশিই ধারাবাহিক পুরস্কৃত হওয়ার অংশ” ছিল। কারণ ৮০ ও ৯০’র দশকে তিনি প্রায় প্রতি বছরই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়ে এসেছেন।
সেই সময়ের বাস্তবতা বলছে, ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন কম রাজনীতিক, বেশি অভিনেতা। অর্থাৎ নিজের অভিনয়ের প্রতি অনেক বেশি ফোকাসড ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন। পক্ষান্তরে আলমগীর চলচ্চিত্র পাড়ার প্রভাবশালী লোকজনদের সাথে অনেক বেশি সংযুক্ত ছিলেন এবং অভিনেতা হিসাবেও ছিলেন শক্তিশালী। সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতাও ছিল অনেক বেশি।
কেন সিপাহী’র ইলিয়াস কাঞ্চন পুরস্কার না পেয়ে দেশ প্রেমিক’র আলমগীর পেলেন? সিপাহী সিনেমার প্রভাব ছিল গভীর কিন্তু হয়তো “চটকদার” ছিল না। দেশপ্রেমিকের গল্প বেশি নাটকীয় হলেও আলমগীরের পারফরম্যান্স বেশ নাটকীয় ছিল, যা কিছু জুরিদের বেশি প্রভাবিত করেছিল। আর এ কারণেই হয়তো ইলিয়াস কাঞ্চনকে টপকে সেরা অভিনেতার পুরস্কার চলে গিয়েছিল আলমগীরের ঘরে।
আজও যদি ‘সিপাহী’ ও ‘দেশ প্রেমিক’ সিনেমা যদি পাশাপাশি চালানো হয়, দর্শকদের অনেকেই বলবেন–ইলিয়াস কাঞ্চন ছিলেন সেরা অভিনেতা। কিন্তু পুরস্কার পেয়েছিলেন আলমগীর। এটি একটি বিতর্কিত অধ্যায়, যা আজও অনেকে ভুলে যেতে পারেন না। আপনার চোখে সিপাহীর ইলিয়াস কাঞ্চন নাকি দেশ প্রেমিকের আলমগীর, কে ছিলেন সেরা অভিনেতা?