জসিম-সুচরিতা: এক তারকা দম্পতির অজানা কাহিনী!

রুপালি ডেস্ক: একটা সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের সিনেমা হলে ভেসে উঠত…“নায়ক জসিম” আর তার পাশে থাকতেন-“নায়িকা সুচরিতা”। তাদের অভিনয়, তাদের রসায়ন, তাদের ভালোবাসা যেন সিনেমার স্ক্রিন ছাপিয়ে পৌঁছে যেত দর্শকের হৃদয়ে। কিন্তু এই পর্দার প্রেম একসময় সত্যিই বাস্তব জীবনে রূপ নেয়… আবার সেই বাস্তবতাই হয়ে যায় এক ভাঙনের ইতিহাস। কি সেই ইতিহাস?  

সুচরিতা ও জসিম-বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় জুটি। তাদের রসায়ন শুধুই অভিনয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না- বরং একে অপরের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্ম নেয় আশির দশকের শুরুতে। জসিম ও সুচরিতা ছিলেন একে অপরের প্রথম জীবনসঙ্গী। তারা জুটি হয়ে প্রায় ১০টির বেশি ব্যবসা সফল ছবিতে অভিনয় করেন।ছবিগুলো হলো আল হেলাল, নাগরানী, অন্যায়, মুজাহিদ, শমসের, মোহাম্মদ আলী, আক্রোশ, রকি, শত্রু ও আদিল।

জসিম-সুচরিতার প্রেম, ভালোবাসা আর ক্যারিয়ার একসাথেই এগিয়ে চলছিল। কিন্তু বাস্তব জীবন সিনেমার মতো সরল হয় না। ১৯৭৬ সালে দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে অভিনয় করার সময় এই ছবির ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা জসিমের সঙ্গে সুচরিতার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ১৯৭৭ সালে পরিণয়। তবে জসিম-সুচরিতার সংসার টিকেছিল মাত্র তিন বছর।

কেন ভেঙে গিয়েছিল জসিম-সুচরিতার সংসার? জানা যায়, সেই সময় প্রয়াত প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক আমজাদ হোসেনের সাথে সুচরিতার নাম জড়িয়ে যায়। যেটা জসিম-সুচরিতার দাম্পত্য জীবনে ফাটল ধরায়! ফলে সুচরিতার সাথে সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে জসিমের। যার শেষটা হয় বিচ্ছেদে।

সুচরিতা দ্বিতীয়বার বিয়ের পিঁড়িতে বসেন ১৯৮৯ সালে। বিয়ে করেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী প্রযোজক কে এম আর মঞ্জুরকে। যিনি দাঙ্গা ও সিপাহী সিনেমা বানিয়ে হইচই ফেলে দেন। সুচরিতার দ্বিতীয় বিয়েও ছিল প্রেমের। সুচরিতা-কে এম আর মঞ্জুর দম্পতির তিন সন্তান। বড় ছেলে আবির পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছেন অস্ট্রেলিয়াতে। মেজ মেয়ে স্নেহা মালয়েশিয়া থেকে সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে বারিধারার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। ছোট মেয়ে এখনও পড়াশোনা করছেন।

সন্তান আর সংসারের ব্যস্ততায় সুচরিতা একসময় ঢালিউড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তবে কে এম আর মঞ্জুরকে বিয়ের ২৩ বছরের মাথায় তাদের দাম্পত্য জীবনেরও ইতি ঘটে। কলহ-বিবাদের মধ্য দিয়ে বিচ্ছেদের পথে হাঁটেন সুচরিতা-কেএমআর মঞ্জুর।

সুচরিতার সাথে বিচ্ছেদের পর কিছু বছর একাই থাকেন জসিম। এরপর তার জীবনে আসে নতুন একজন। তখনকার সময়ের স্টাইলিশ অভিনেত্রী নাসরিন। এই নাসরিন ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র “মুখ ও মুখোশ”-এর নায়িকা পারভীন বানু ওরফে পূর্ণিমা সেন গুপ্তার মেয়ে। সুন্দরী, মার্জিত, গ্ল্যামারাস-জসিম যেন পেয়েছিলেন নতুন ভালোবাসার স্থির ঠিকানা।

জসিমকে বিয়ের পর নাসরিন পুরোপুরি সংসারে মন দেন। জসিম-নাসরিন দম্পতির সংসারে জন্ম নেয় তিন পুত্র: এ কে রাতুল, এ কে সামি এবং এ কে রাহুল। তিনজনই ব্যান্ড সংগীতের সাথে জড়িত। জসিমের বড় ছেলে সামি ও মেজো ছেলে রাতুল ২০০৭ সালে ৫ সদস্য নিয়ে গড়ে তোলেন ব্যান্ড দল ‘ওন্ড’। এই ব্যান্ডের প্রধান এবং ড্রামার সামি। রাতুল বেজ গিটার বাজানোর পাশাপাশি কন্ঠ দিয়ে থাকেন। জসিমের ছোট ছেলে রাহুল আছেন ‘ট্রেইনরেক’ এবং ‘পরাহো’ ব্যান্ডের সঙ্গে।

বাবা এত বড় সুপারস্টার হওয়ার পরেও জসিমের ছেলেরা কেন অভিনয়ে আগ্রহী হলেন না এমন প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়ে জসিমের ছেলেদের। এক সাক্ষাৎকারে জসিমের ছোট ছেলে রাহুল বিষয়টি খোলাসা করেছেন। তিনি মিউজিক বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে বলেন,“ ছোট থেকে আমাদের মিউজিকের প্রতি অ্যাটাচমেন্ট বেশি ছিল। প্যাশনটাও বেশি ছিল। বাবার কাছ থেকে একটা জিনিস আমরা পেয়েছি যেটা ভালো লাগবে সেটার প্রতি লেগে থাকা। বাবার ভালোবাসাটা ছিল মুভিতে আমাদের ভালোবাসাটা মিউজিকে।’

১৯৯৮ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে বাংলা সিনেমার অ্যাকশন লিজেন্ড  জসিম মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুতে চলচ্চিত্র জগতের পাশাপাশি ভেঙে পড়েন অসংখ্য ভক্ত। অ্যাকশন আর অভিনয়ের দুর্দান্ত কম্বিনেশন আজও জসিমভক্তরা মিস করেন।

জসিম-সুচরিতা আমাদের চোখে ছিলেন স্বপ্নের জুটি। তাদের গল্পের শেষটা কষ্টের হলেও, তারা দুইজনেই নিজেদের মতো করে জীবনকে এগিয়ে নিয়েছেন। জসিম শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত সংসার, সন্তান, আর ক্যারিয়ারকে ধরে রেখেছিলেন। আর সুচরিতা একাধিক সম্পর্কের ভাঙনের পরেও দাঁড়িয়ে আছেন সম্মানের জায়গায়। জসিম বা সুচরিতার কোন ছবিটি আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে?  কমেন্ট করে জানাতে পারেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *